Site icon The Bangladesh Chronicle

ভ্রান্তির সংশোধন প্রসঙ্গ


‘রিয়ার অ্যাডমিরাল মাহবুব আলী খান : একজন সামরিক নেতা’ শিরোনামে ১৮ মে নয়া দিগন্তে প্রকাশিত কলামটি প্রশংসার দাবি রাখে। তার পারিবারিক পরিচিতির কিছু তথ্য অন্য সূত্রে অসমর্থিত হওয়ায় এর গ্রহণযোগ্যতা লেখকনির্ভর। ইতিহাসের অনস্বীকার্য সত্যটি হলো, ভারতবর্ষে শাসক পরিবর্তনের কারণেই পিছিয়ে পড়া অন্যান্য প্রাদেশিক মুসলমানের তুল্যতায় বিশেষত পূর্ববঙ্গের (বাংলাদেশ) সমকালীন মুসলমানের সার্বিক অবস্থা ব্রিটিশ-ভারতীয় ইতিহাসে নিদারুণ নিষ্প্রভ।

‘বাঙালির মুক্তিযুদ্ধের অন্তরালে শেখ মুজিব’ নামক বই-এর ৩২ পৃষ্ঠায় লেখক ডা: কালিদাস বৈদ্য লিখেছেন, ‘দেশ ভাগের সময় পূর্ববঙ্গের মুসলমান সমাজের মান ছিল খুবই নিচু। হিন্দু সমাজের পিছিয়ে পড়া অংশ ছিল নমঃসম্প্রদায়। মুসলমানরা ছিল তাদের থেকেও পিছিয়ে। গোটা পূর্ববঙ্গে একজন মুসলমান পিএইচডি ডিগ্রির অধিকারী ছিল না। … পূর্ববঙ্গের নমঃসমাজে পিএইচডি ডিগ্রিধারী বিদ্বানরা ছিলেন, যেমন ফরিদপুরের ওড়াকান্দি গ্রামের ভগবতী ঠাকুর। পূর্ববঙ্গে কোনো মুসলমান এমআরসিপিএস বা এফআরসিএস ডাক্তার ছিল না। কিন্তু নমঃসমাজে তেমন অনেক ডাক্তার ছিলেন। যেমন খুলনার ডাক্তার জ্ঞান মণ্ডল এমআরসিপি। কোনো মুসলমান আইসিএস অফিসারও ছিল না। ছিলেন একমাত্র নমিনেটেড আইসিএস নুরননবী চৌধুরী। তিনি যুদ্ধের সময় সামরিক দপ্তরে অফিসার ছিলেন। সেই কারণে তিনি নমিনেটেড আইসিএস হতে পেরেছিলেন। নমঃসমাজে আইসিএস অফিসার ছিলেন খুলনার সুকুমার মল্লিক। মুসলমান সমাজের কেউ আইএফএস (ইন্ডিয়ান ফরেন সার্ভিস) ছিল না। নমঃসমাজে আইএফএস অফিসার ছিলেন ফরিদপুরের লক্ষ্মী নারায়ণ রায়।…. নমঃসমাজে ব্যারিস্টার ছিলেন ফরিদপুরের ওড়াকান্দির পিআর ঠাকুর, সুরেশ বিশ্বাস, খুলনার শশিভূষণ মণ্ডল এবং বরিশালের ভূবন মণ্ডল। এরা সবাই ত্রিশের দশকের প্রথম দিকেই ব্যারিস্টার হয়েছিলেন। অথচ পুরো পূর্ববাংলায় মুসলমানদের মধ্যে তখন একজনও ব্যারিস্টার ছিল না। … ব্যবসা বাণিজ্যের ব্যাপারেও সেই একই অবস্থা ছিল। বড় আকারের ব্যবসা বাণিজ্য দূরের কথা, ছোটখাটো ব্যবসাতেও মুসলমানদের খুঁজে পাওয়া যেত না।’

তিনি আরো লিখেছেন, ‘এদের মধ্যে ব্যারিস্টার ভূবনচন্দ্র মণ্ডলের নাম আমার কৈশোরেই ছিল সুবিদিত। ১৯৭১ সালে আমাদের ইউনিয়নের শহীদ চেয়ারম্যান দীনেশচন্দ্র মণ্ডলের তিনি ছিলেন সহোদর তথা জেলার অদ্বিতীয় শিক্ষিত ও কলকাতায় আইন পেশায় নিয়োজিত। ত্রিশের দশক তো দূরের কথা, দেশ ভাগের পরে এমনকি, ষাটের দশকের প্রায় মাঝামাঝি সময়েও ব্যবসা বাণিজ্যের ক্ষেত্রে আমাদের চতুর্পার্শ্বে চারটি থানার বন্দরসহ জেলা শহরে মুসলমানের একটা পানবিড়ির অন্তত সাধারণ ও ক্ষুদ্র দোকানও ছিল না।’

কলামটির মতে, ‘১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পরে মাহবুব আলী খানের শৈশব ও কৈশোর ঢাকার পুরানা পল্টনে কাটে।’ তাহলে তার ব্যারিস্টার পিতার ও আইসিএস চাচার উল্লেখ ডা: বৈদ্যের বই-এ না করাই বিস্ময়কর বলে মনে হওয়াই স্বাভাবিক। এ ছাড়াও ১৭৮১ থেকে ১৯৭৬ পর্যন্ত গোটা উপমহাদেশের সর্বমোট ৬৯০ জন সুখ্যাত মুসলমানের তথ্যনির্ভর জীবনচরিতের সঙ্কলন, নরেশ কুমার জৈনের ‘MUSLIMS IN INDIA, A BIOGRAPHICAL DICTIONARY’ নামক দুই খণ্ডের বহুল প্রচালিত বই রয়েছে। এর মধ্যে সিলেটসহ আসামের উল্লিখিত, মোট ১৩ জন মুসলিম বিশিষ্টজন হলেন : ১. আব্দুল মতিন চৌধুরী (১৮৯৫-১৯৪৯) ২. আব্দুর রশিদ চৌধুরী (১৮৮৩-১৯৪৪) ৩. আব্দুল মোতালেব মজুমদার (১৮৯৪-?) ৪. মওলানা মো: তায়েবুল্লাহ (১৮৯৪-১৯৬৭), আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক ছিলেন ৫. স্যার সৈয়দ মো: সাদুল্লাহ (১৮৮৫-১৯৫৫) ৬. হারুনার রশিদ (১৯০১-?) ৭. জাহানুদ্দীন আহাম্মদ (১৯০৪-?) ৮. প্রফেসর ডা: এমরান হোসেন চৌধুরী (১৯১৪-?) বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক ছিলেন। ৯. সৈয়দ আব্দুল মালেক (১৯১৯-?) ১০. আব্দুস সত্তার (১৯২২-?) ১১. মইনুল হক চৌধুরী (১৯২৩-১৯৭৬), ১২. পীয়ার মহাম্মদ (১৯২৬-?) ১৩. বেগম মোফিদা আহাম্মদ (১৯২১-?)। এরা অনেকেই আইনজীবী, লেখক, বিধান, লোকসভা সদস্য ও মন্ত্রী ছিলেন। তবে কেউই ব্যারিস্টার বা আইসিএস ছিলেন না।

খান সাহেবের পরিবার সিলেটের, যা ছিল তখন আসামের অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু তৎসত্ত্বেও বিশেষ কৃতিত্বের অধিকারী তার পিতা ও চাচার নাম এই বইটিতে থাকার অপরিহার্যতায়ও না থাকার কারণ তথ্য বিভ্রাট বলা যায়। এতে বলা হয়েছে, “মাহবুব আলী খানের বাবা ছিলেন উপমহাদেশে প্রথম মুসলিম ব্যারিস্টার আহম্মদ আলী খান, যিনি ১৯০১ সালে ব্যারিস্টার হন। তিনি নিখিল ভারত আইন পরিষদের সদস্য ও আসাম কংগ্রেসের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। … তার অপর ভাই গজনফর আলী খান ১৮৯৭ সালে ভারতে চতুর্থ মুসলিম হিসাবে আইসিএস লাভ করেন এবং তাকে কর্মদক্ষতার স্বীকৃতিস্বরূপ ব্রিটিশ সরকার ১৯৩০ সালে ‘অফিসার অব দ্য ব্রিটিশ এম্পায়ার’ এবং ‘সিআইই’ উপাধিতে ভূষিত করেন।…. মাহবুব আলী খানের পিতা আহম্মদ আলীর মামা তৎকালীন ভারতের সুবিখ্যাত লেখক, আইনজীবী ও বিচারপতি সৈয়দ আমীর আলী ছিলেন কলকাতা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি।”

এর প্রকৃত ব্যাপার হলো : ১৮৭৩ সালে কলকাতা হাইকোর্টে প্রথম মুসলিম ব্যারিস্টার হলেন সৈয়দ আমীর আলী এবং ১৮৯০ সালে হন প্রথম মুসলিম বিচারপতি। আরবি ও ফার্সি জানলেও তিনি কথা বলতেন উর্দু ও ইংরেজিতে এবং ছিলেন শিয়া মতাদর্শী। তার ওপর হুগলির ইমামবাড়াসহ হুগলি কলেজের অধ্যক্ষ তথা ‘ইংরেজ মাতা’ রবার্ট থাওয়াটিস-এর (Robert Thawaytes) যথেষ্ট প্রভাব ছিল। মাহবুব আলী খানের পিতার মামা এবং তার চাচার চতুর্থ মুসলিমস্বরূপ আইসিএস ডিগ্রি অর্জনের কলামটির তথ্য লেখকনির্ভর বটে।

অন্য দিকে দ্বিতীয় সত্যটি হলো : আমীর আলী ছাড়াও ‘কিশোরগঞ্জের ভাগ্নে’ ও ত্রিপুরার জমিদারপুত্র আব্দুর রসুল অক্সফোর্ডে পড়াশোনা, ব্যারিস্টারি ও ১৮৯৮ সালে বিসিএল ডিগ্রিধারী প্রথম বাঙালি মুসলমান বিধায় মাহবুব আলী খানের পিতাকে ১৯০১ সালের ব্যারিস্টার বলে ধরে নিলেও প্রথম মুসলিম ভাবা ভ্রান্তি বৈকি।

Exit mobile version