বিচারব্যবস্থা ভেঙে পড়লে অপশক্তি সমাজকে গ্রাস করবে: বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দার

বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দার

বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দার

পরিবারের গৃহকর্তা তথা অভিভাবককের মতো জ্যেষ্ঠ বিচারকেরা জুনিয়র বিচারকদের স্নেহ ও দিকনির্দেশনা দেবেন, এমন প্রত্যাশা করেছেন আপিল বিভাগের বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দার। তিনি বলেছেন, ‘তাঁদের আগলে রেখে পথ দেখাতে হবে, যাতে তাঁরা সব প্রতিকূলতা অতিক্রম করে তাঁদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে পারেন। আর তা না হলে বিচারব্যবস্থার সঙ্গে জড়িত দুই-একজনের পদস্খলনে পুরো বিচারব্যবস্থাই ভেঙে যাবে। একবার যদি বিচারব্যবস্থা ভেঙে পড়ে, তাহলে যেকোনো সময় অপশক্তি আমাদের দেশ ও সমাজকে গ্রাস করবে।’

আজ রোববার দুপুরে ভার্চ্যুয়ালি আয়োজিত এক বিদায় সংবর্ধনায় তিনি এসব কথা বলেন। প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন, আপিল বিভাগের বিচারপতি ও আইনজীবীরা অনুষ্ঠানে যুক্ত ছিলেন। ১৯৫৪ সালের ১ মার্চ জন্মগ্রহণ করা আপিল বিভাগের এই বিচারপতির ৬৭ বছর পূর্ণ হচ্ছে ২৮ ফেব্রুয়ারি। এ হিসাবে আজ ছিল তাঁর শেষ কর্মদিবস, যার মধ্য দিয়ে তাঁর ২০ বছরের বিচারিক কর্মজীবনের ইতি ঘটতে যাচ্ছে। প্রথা অনুসারে আজ বিচারপতিকে বিদায় সংবর্ধনা জানানো হয়।

প্রথমে অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন ও পরে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির পক্ষে সম্পাদক রুহুল কুদ্দুস বিদায়ী বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দারের কর্মময় জীবন নিয়ে বক্তব্য দেন। এরপর বক্তব্য দেন বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দার।

বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দার বলেন, ‘বিচার বিভাগে দুর্নীতির কালো মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে—এই অনাকাঙ্ক্ষিত অপপ্রচার আজকাল প্রায়ই আমাদের কানে আসে। বিচারব্যবস্থায় কারও একক অধিকার নেই এবং কারও একক প্রয়াসে তা চলতে পারে না। সমষ্টিগত প্রয়াসেই একটি ঐকান্তিক প্রচেষ্টা ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার একমাত্র পূর্বশর্ত।

তাই বিচারক থেকে শুরু করে বিচারব্যবস্থার সঙ্গে সম্পৃক্ত সবাইকেই একে অপরের সঙ্গে নিবিড়ভাবে সংযুক্ত হয়ে কাজ করতে হবে। সুবিচার ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হলে বিচারালয়ের সর্বনিম্ন কর্মকর্তা থেকে সর্বোচ্চ পদাধিকারীর ঐক্যবদ্ধ থাকা একান্ত প্রয়োজন।’

বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দার বলেন, ‘সাংবিধানিকভাবে বিচার বিভাগ স্বাধীন। তবে বাস্তবে কতটুকু, তা আমরা সবাই জানি ও বুঝি। রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গ—নির্বাহী বিভাগ, আইন বিভাগ ও বিচার বিভাগ। এই তিন বিভাগের চৌহদ্দি সংবিধানে লক্ষণরেখার মাধ্যমে নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। একে অপরের পরিপূরক হিসেবে থাকারও নির্দেশনা আছে। এখানে প্রত্যেককেই নিজ নিজ পরিধির মধ্যে থেকে কে কতটুকু কাজ করবে, তা আমাদের সংবিধান নির্দিষ্ট করে দিয়েছে, যাতে কেউ লক্ষণরেখা অতিক্রম করতে না পারে।’

নবীন আইনজীবীদের উদ্দেশে বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দার বলেন, ‘প্রথম জীবনে লার্ন (শিক্ষা) বাদ দিয়ে আর্ন (উপার্জন) করা শুরু করেন, তাহলে আপনার ঝুড়িতে আর্ন হবে ক্ষণিকের জন্য, স্থায়ী হবে না। অনুরোধ, সবাই লার্ন করতে পারলে একজন বিচারক আপনার জ্ঞানের ওপর আস্থা রাখতে পারবেন। তখনই দেখবেন আপনার আর্নিংয়ের পরিধি অনেক বিস্তৃত হয়েছে। এ পেশায় লেখাপড়ার কোনো বিকল্প নেই।’

বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দার বলেন, ‘অনেক সময় বিচার বিভাগ প্রদত্ত আইনের ব্যাখ্যা নিয়ে সমালোচনার ঝড় ওঠে। এই ক্ষেত্রে একজন বিচারক ও বিচারব্যবস্থাকে এক করে ফেলি। আমরা ভুলে যাই, বিচারকও একজন মানুষ। বিচারব্যবস্থা হলো সবার ঐকান্তিক প্রচেষ্টার দীর্ঘদিনের সাক্ষী-সাবুদ ও আইনের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের ফল। বিচারের রায় বিপক্ষে গেলে সংক্ষুব্ধ পক্ষ বিচারককে বিতর্কিত করতে কোনো মন্তব্য করলে তা যেমন অন্যায়, তেমনি যার পক্ষে রায় যায়, তারও স্তুতিবাক্যে কোনো বিচারককে বিভ্রান্ত করাও অন্যায়। অনুরোধ, বিচার–বিশ্লেষণ না করে এবং আইনের তত্ত্ব, তথ্য ও উপাত্ত পরিষ্কারভাবে না জেনে কোনো রায়কে কেউ যেন বিতর্কিত না করে। অযৌক্তিকভাবে আদালতের ঘোষিত রায় বিতর্কিত করার এই চলমান প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকলে জাতি হিসেবে আমাদের অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হবে।’

বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দার বিশ্বাস করেন, ‘আমরা যদি নিজ নিজ অবস্থান থেকে নিজ নিজ দায়িত্ব–কর্তব্য সঠিকভাবে পালন করি এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে কাজ করার দৃঢ় মানসিকতা নিয়ে নিজের কাছে যদি শপথ নিই, তাহলে আমরা অবশ্যই সুশাসন দ্বারা আমাদের সার্বভৌম স্বাধীন বাংলাদেশকে সোনার বাংলায় গড়তে পারব। অনুরোধ, আমরা যেন এমন কিছু না করি, যাতে সুবিচারের প্রতীক শ্বেতশুভ্র অট্টালিকাটির গায়ে যেন এতটুকু কালিমা লাগে।’